হিমালয়ের পাদদেশে হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত মানালি শহর। এর একদিকে যেমন রয়েছে হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বত শ্রেণী, সোলাং ভ্যালি, পার্বতী ভ্যালি তেমন রয়েছে বিপাশা নদী ও যোগিনী জলপ্রপাত, রয়েছে মনিকারণ গুরুদ্বারা আর রয়েছে হিড়িম্বা দেবীর মন্দির। এছাড়াও রয়েছে আরও অনেককিছু যা প্রত্যেক বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটককে এই মানালিতে টেনে নিয়ে আসে।
মানালি নামের উৎপত্তি "মনুর আলয়" থেকে ।পুরানে কথিত আছে, মহাপ্রলয়ের পরে তার আবির্ভাব ঘটে মানালিতে। আর এই মহর্ষি মনুই হচ্ছেন মানব জাতির সৃষ্টিকর্তা। হাজার বছর কঠোর তপস্যা করার পরে একদিন নদীর একটি ছোট মাছ তাঁর কাছে প্রার্থনা করে, বড় মাছেদের মুখ থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য। তখন তিনি সেটিকে একটি জালার মধ্যে রেখে দেন। একটু বড় হতেই, মাছটিকে পুকুরে, তারপরে গঙ্গায় ছেড়ে দেন। এরপর মাছটি বিশাল আকার ধারণ করলে, তাকে সমুদ্র ছেড়ে দেন।সেই মাছটি তখন মনুকে বলেন, "প্রলয় আসছে, সারা পৃথিবী জলের তলায় ডুবে যাবে। কিন্তু আপনি আমায় রক্ষা করেছেন, তার প্রতিদান স্বরূপ আমিও আপনার জীবন রক্ষা করব। আপনি সপ্তর্ষিদের সঙ্গে নৌকায় উঠে তার কাছি (মোটা দড়ি) আমার গজিয়ে ওঠে শিঙে বেঁধে দিলে বাকি কাজ আমি করে দেব।"
মাছের কথামত কাজ করে দিলে, মাছ নৌকা গভীর সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে হিমালয়ের একটি চূড়ার কাছে এনে মনুকে বলেন সেই চূড়ার সঙ্গে কাছিটা বাঁধতে। এরপর সেই মাছটি নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন যে তিনিই "প্রজাপতি ব্রহ্মা"। এরপর ব্রহ্মার বরে মনু সৃষ্টি করেন মানবজাতি।
এই মানালির ঢুঙরি পাহাড়ে পাইন দেবদারু বনের মধ্যে বিপাশা নদীর পাশে রয়েছে হিড়িম্বা দেবীর মন্দির।২৭ মিটার উঁচু কাঠের তৈরি প্যাগোডার আকারের এই মন্দির অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির তৈরী করেন মহারাজ বাহাদুর সিং।চারটি ধাপে তৈরী এই মন্দিরের গায়ে খোদাইকরা নানা দেবদেবী ও জীবজন্তুর মূর্তি।ভিতরে পাথরের বেদীর উপরে পিতলের তৈরী দেবী হিড়িম্বার মূর্তি।আর এই মূর্তির মধ্যে দেবী হিড়িম্বা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছেন।মহাভারতে হিড়িম্বাকে রাক্ষসী বলা হলেও কুলু মানালির লোকের কাছে সুদূর অতিতকাল থেকে তিনি দেবী দুর্গা রূপে পূজিত হয়ে আসছেন।তাঁদের বিশ্বাস দেবী হিড়িম্বা ও দেবী দুর্গা এক এবং অভিন্ন। প্রতি বছর মে মাসে দেবী হিড়িম্বার বিশেষ পূজো অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময় এখানে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়।
মহাভারতে আছে, জতুগৃহ থেকে রক্ষা পাওয়ার পর পঞ্চপাণ্ডব মা কুন্তিকে নিয়ে পালিয়ে যান এক দুর্গম অরণ্যে। সেখানে একটি শালগাছে বাস করতেন হিড়িম্ব ও হিড়িম্বা নামে দুজন রাক্ষস ও রাক্ষসী যারা সম্পর্কে ছিলেন সহদর ভাই বোন। পথশ্রমে ক্লান্ত পাণ্ডবেরা কুন্তি সহ সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন, ভীম ছাড়া। পাহারায় রইলেন ভীম একা।
গাছের উপর থেকে তাঁদের দেখে নরমাংস লোলুপ হিড়িম্ব বোন হিড়িম্বাকে পাঠিয়ে দেন তাদেরকে হত্যা করে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু হিড়িম্বা ভীমের বিশাল চেহারা ও রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি হত্যা না করে ভীমকে বিবাহ করবেন বলে স্থির করেন। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ভাইয়ের আদেশ অমান্য করে নিজে এক ষোড়শী সুন্দরী রূপান্তরিত হয়ে যান। ভীমের সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন যে তিনি তার ভাই নারখাদক হিড়িম্বর আদেশ অনুযায়ী এখানে পাণ্ডবদের হত্যা করার অভিপ্রায় নিয়ে এখানে এসেছিলেন কিন্তু ভীমকে দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করতে চান।বিবাহের পরে সবাইকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু নির্ভীক ভীম জানালেন যে তিনি কারও ভয়ে ভীত নন। ইচ্ছা করলে হিড়িম্বা তাঁর কাছে থাকতে পারেন কিংবা ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিতে পারেন।
এদিকে বোনের ফিরতে দেরি হওয়ায় জন্য হিড়িম্ব পাণ্ডবদের কাছে এসে দেখেন তাঁর বোন ভীমকে বিবাহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দেখেই প্রচন্ড রেগে গিয়ে ভীমকে মারতে উদ্যত হলেন। কিন্তু ভীমও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। হিড়িম্বকে দু হাতে তুলে আছাড় মেরে তার কোমর ভেঙে দিলেন এবং তাকে বধ করেন।
এরপর, যুধিষ্ঠিরের আদেশে হিড়িম্বাকে বিবাহ করেন ভীম ও তাদের এক মহা পরাক্রমশালী পুত্র ঘটৎকচ এর জন্ম দেন হিড়িম্বা। পরের ঘটনা আমাদের সবার জানা।কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের হয়ে যুদ্ধ করেন ঘটৎকচ ও তার পুত্র অঞ্জনপর্ব এবং বীরের মতন মৃত্যু বরণ করেন যথাক্রমে কর্ণ ও অশ্বথমার হাতে।
মহাভারতে হিড়িম্বাকে রাক্ষসী বলা হলেও কুলু মানালির লোকের কাছে সুদূর অতিতকাল থেকে তিনি দেবী দুর্গা রূপে পূজিত হয়ে আসছেন।তাঁদের বিশ্বাস দেবী হিড়িম্বা ও দেবী দুর্গা এক এবং অভিন্ন। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস রাবন বধের সময় হিড়িম্বা দেবী দুর্গা রূপে রামচন্দ্রের সঙ্গে যোগ দেন।
কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। লোকবিস্বাস থেকে লৌকিক দেব দেবীদের সৃষ্টি হয়। হিড়িম্বা হচ্ছেন এইরকমই একজন দেবী। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস দেবী দুর্গা যেমন দুর্গতি নাশিনী, তেমন দেবী হিড়িম্বাও সমস্ত বিপদ থেকে তাদের উদ্ধার করেন। তাই তিনিও দুর্গা।
এখনো দশেরা হচ্ছে কুলু উপত্যকার সবচেয়ে বড় উৎসব। দশেরার সময় কুলুর ঢালপুর ময়দানে প্রতি বছর বিরাট মেলা হয়। দশ দিন ধরে চলে এই মেলা। বিভিন্ন গ্রামের উপাস্য দেবতাদের রথে করে শোভাযাত্রা সহযোগে এই মেলায় নিয়ে আসা হয়। দেবী দুর্গরূপে, দেবী হিড়িম্বা মানালি থেকে কুলুতে আসেন সবার আগে। আবার দশ দিন থাকার পরে দশেরার দিনে সবার আগে বিদায় নেন দেবী হিড়িম্বা। ফিরে আসেন তার মানালির মন্দিরে। আবার একই অঙ্গে অবস্থান করেন দেবী দুর্গা ও দেবী হিড়িম্বা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
কালী প্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারত, সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত "পৌরাণিক অভিযান" ও "ভ্রমণ সঙ্গী" এবং রাধারমণ রায় রচিত কাহিনী।
No comments:
Post a Comment