কলমে : দেবাশীষ চাকলাদার
কথায় আছে "বাঙালির বার মাসে তের পার্বন"। এর মধ্যে বাংলার ক্যালেন্ডারে জ্যৈষ্ঠ মাস আসলেই যে পার্বন জানান দেয়, তার নাম "জামাই ষষ্ঠী "। জামাইষষ্ঠী বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিক লৌকিক আচার।জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই আচার পালন করা হয়।এই দিনে বিবাহিত মেয়ে ও জামাইকে নিমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করা হয়।এভাবে জামাইকে খুশি রাখার চেষ্টায় ষষ্ঠীপুজোর লৌকিক প্রথাই হয়ে উঠে বাঙালির জষ্টি মাসের উৎসব।
জামাইষষ্ঠীর দিন বিশেষ ব্রত পালন করে শাশুড়িরা মেয়ে ও জামাইয়ের মঙ্গল কামনা করেন। এই দিনে ফুল, বেলপাতা দিয়ে সুতো বেঁধে দেওয়ার অর্থ হল, মেয়ে ও জামাইয়ের অটুট বন্ধনে সুখের কামনা করা। এরপর পাখা দিয়ে বাতাস করা হয় জামাইকে। মনে করা হয়, এই রীতির অর্থ হল, জামাইয়ের ধারে কাছে ঘিরে থাকা খারাপ সময় যাতে দূরে চলে যায়।
এরপর তিনবার জামাইকে 'ষাট' বলেন শাশুড়িরা। মনে করা হয়, এর অর্থ হল, জামাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করা। আশীর্বাদ করা হয়, ধান ও দূর্বা দিয়ে। উল্লেখ্য, ধান সমৃদ্ধির প্রতীক ও দূর্বা সতেজতার প্রতীক। ফলে জামাই যেন চির নবীন ও সমৃদ্ধি পান, তার জন্য এই আশীর্বাদ করার রীতি রয়েছে বলে মনে করা হয়।
ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একসময় সংস্কার ছিল কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয় ততদিন কন্যার পিতা বা মাতা কন্যাগৃহে পদার্পণ করবেন না ৷ এই ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দেয়, সন্তানধারণে সমস্যা বা সন্তান মৃত্যুর (শিশুমৃত্যু) ফলে কন্যার পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত কন্যার বাড়ি যাওয়ার জন্য ৷ সেক্ষেত্রে বিবাহিত কন্যার মুখদর্শন জন্য সমাজের বিধানদাতা জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীকে বেছে নেয় জামাই ষষ্ঠী হিসাবে ৷ যেখানে মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করে সমাদর করা হবে ও কন্যার মুখ দর্শন করা যাবে এবং সেইসঙ্গে মা ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁকে খুশি করা যাতে কন্যা শীঘ্র পুত্রমুখ দর্শন করতে পারে[
জামাইষষ্ঠী ঘিরে রয়েছে এক প্রচলিত লোককথা। সেখানে বলা হচ্ছে, যে, একটি পরিবারে দুটি বউ ছিলেন। দুই বউয়ের মধ্যে ছোট বউ লোভী ছিল। যিনি সর্বদা বাড়িতে যখন ভালো খাবার রান্না হত তা লুকিয়ে খেয়ে নিত এবং বিড়ালের উপর দোষ চাপাতেন। বিড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন। নিজের বাহন বেড়ালের নামে এমন অভিযোগ শোনার পর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। ফলস্বরূপ ছোট বউয়ের সন্তানের প্রাণ কেড়ে নেন। কষ্টে ভেঙে পড়েন সেই বাড়ির ছোট বউ। পরে এক বৃদ্ধার রূপ ধারণ করে দেবী ষষ্ঠী তাঁর কাছে যান। ছোট বউকে তাঁর আচরণের কথা মনে করিয়ে দেন। ভুল বুঝতে পেরে, নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ায় ষষ্ঠী দেবী ছোট বউকে তাঁর সন্তান ফিরিয়ে দেন।তবে ঘটনাটি জানতে পেরে শ্বশুরবাড়ির লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে তার বাবার বাড়িতে যেতে বাধা দেয়। ষষ্ঠী পূজার দিন তাদের মেয়েকে দেখতে আগ্রহী বাবা-মা তাদের জামাই এবং তাদের মেয়েকে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তাই সেই দিনটি জামাই ষষ্ঠী নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি পুনর্মিলন এবং আনন্দের দিন হিসাবে পালিত হয়।[
এই দিনে শাশুড়ি দেবী ষষ্ঠীকে খুশি করার জন্য ষষ্ঠী পূজা করেন এবং তার কন্যা এবং জামাইদের সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির জন্য তার আশীর্বাদ চান। জামাইকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং শাশুড়ির তৈরি নিরামিষ এবং আমিষ উভয় খাবারের একটি দুর্দান্ত ভোজ খাওয়ানো হয়। এই দিনে জামাই মেয়েকে উপহারও দেওয়া হয়। জামাই ষষ্ঠী একটি পরিবারের একত্রিত হওয়ার দিন হিসাবে উদযাপন করা হয় এবং পরিবারের সবাই একসাথে খাবার খাওয়ার মাধ্যমে একত্রিত হয়ে উদযাপন করা হয়।
এই জামাই ষষ্ঠী পার্বনটি প্রায় কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। যখন হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ হয়নি প্রায় তখন থেকেই। যদিও সপ্তদশ শতকে লেখা কিছু বইতে এর উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু প্রচার লাভ করে উনিশ শতকে।তখন থেকেই জামাইকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হয়।জামাই এবং তার পরিবারের লোকজনই হয়ে ওঠে কোন মহিলার ভাগ্যবিধাতা। বাল্যবিবাহ, অপরিমিত নারীশিক্ষা পুরুষদের বহুবিবাহ এর মূল কারণ বলে মনে করা হয়। তাই মেয়ের ভবিষ্যত অনেকাংশ নির্ভর করত জামাই ও তার পরিবারের উপর। তাই মেয়ের মায়েরা জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় করতেন জামাইষষ্ঠী। তখনকার দিনে মেয়ে বিয়ের পরে বাপের বাড়িতে আসা খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না। তাই সেদিকথেকেও এই সুযোগে মেয়ের দর্শন লাভও হয়ে যেত।
উনিশ শতকে যখন কলকাতায় ছিল বাবু কালচার, তখন জামাই ষষ্ঠী হয়ে ওঠে একধরণের স্টেটাস সিম্বল। ১৮৫১ সালে সংবাদ প্রবাহ পত্রিকায় হেমন্ত মিত্র মজা করে লিখেছিলেন," মিহি সুতোয় বোনা ঢাকাই ধুতি পাঞ্জাবী পরে, হাতে কোঁচা নিয়ে, কাঁধে বেনারসি চাদর বা গলায় রুমাল পেঁচিয়ে জামাই শ্বশুর বাড়ি যেতেন।
তবে তখন জামাইকে তোয়াজ আর খাতির করার পাশাপাশি চলত জামাইকে বোকা বানানোর নানান রকম ফন্দিফিকির। যেমন, নুনের পায়েস, তেলা কচুর চাটনি ও স্যালাড। শোনা যায় যে বিখ্যাত জলভরা সন্দেশর উৎপত্তিও এর থেকেই। শোনা যায় ১৮৫২ সালে তেলেঙ্গা পাড়ায় জামাই ষষ্ঠীর আগে ডাক পরে ময়রা সূর্যোকুমারের। তাকে ডেকে বলা হয় এমন একটি মিষ্টি বানাতে। কড়া পাকের ছানার সন্দেশে কামড় দিতেই জামাই বাবাজির গিলে করা পাঞ্জাবী ভিজে যায় সন্দেশের ভিতরে থাকা রসে।
অশোক মুখোপাধ্যায় তার সমার্থক শব্দেকোষে লিখেছেন," জামি" বা "জমী" শব্দের অর্থ "পতিব্রতা স্ত্রী" বা "কূলবধূ"। এই জামি শব্দের বহুবচন হল "জাময়'। অনেকজন পতিব্রতা স্ত্রী একত্রিত হয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠীর দিনে স্বামীর কল্যাণ কামনায় একসাথে এই ব্রত পালন করতেন, তাই একে বলা হত জাময় ষষ্ঠী। তখনকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই জাময় ষষ্ঠী থেকেই আসে জামাই ষষ্ঠী। তখন দীনবন্ধু মিত্রের রচনাতেও জামাই ষষ্ঠী কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
আমাদের মা দিদিমা বা ঠাকুমায়েরা শুধু জামাই ও মেয়ে নয়, তাদের সন্তানদেরও পাশে বসিয়ে আশীর্বাদ করে মিষ্টি ফলমুলের প্লেট সাজিয়ে তাদের হাতে তুলে দেন। তাই এই উৎসব শুধুমাত্র জামাই কেন্দ্রিক ছিল না। সকলের মঙ্গল কামনায় করা হত। কিন্তু বাবু কালচার এর যুগে এটিকে শুধু মাত্র জামাই কেন্দ্রিক করে দেওয়া হয়েছে।
দেবেন্দ্র কুমার সরকার মহাশয় তার "বারো মাসে তেরো পার্বন " নামক বই এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, তেরোটি পার্বনই আসলে মা ষষ্ঠীর পূজা। এর মধ্যে বাংলার জ্যৈষ্ঠ মাসে মা ষষ্ঠীর যে পূজা হয় তাকেই বলা হয় জামাই ষষ্ঠী।
মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যেও মা ষষ্ঠীর উল্লেখ আছে। কিন্তু সেখানে মায়ের মূর্তির কোন আকার নেই। বট, অস্বথ বা কাঁঠাল গাছের ডাল মাটিতে পুতে বেলপাতা, আমপাতা ফুল দিয়ে মা ষষ্ঠীরূপে আরাধনা করা হত। তাই এটিকে অরণ্য ষষ্ঠী নামেও অভিহিত করা হত। আসলে সন্তানের মঙ্গল কামনায় মায়ের কাছে আরাধনা করাই এর উদ্দেশ্য।আজও সন্তান জন্মবার পরে ছ দিনের দিন এবং একুশ দিনের দিন তার নীরোগ জীবনের মঙ্গল কামনায় মা ষষ্ঠীর পুজো করা হয়।
মুকুন্দ রাম চক্রবর্তী, চন্ডীমঙ্গল কাব্যে লিখেছেন,
"দুয়ারে বন্ধিল জল
বেত্র উপনাদে
ফেরিয়াচালের খড়
জ্বালিল আতুরি
গো মুন্ডে থুইয়া দ্বার
পূজে ষষ্ঠীবুড়ি "
এই পার্বন অন্য পরিবার থেকে আসা জামাইকে নিজের পরিবারের একজন করে নেবার দেবার পার্বন, নিজের সন্তান করে নেবার পার্বন।আদিম কাল থেকেই সন্তানদের মঙ্গল কামনায় এই পার্বন চলে আসছে, এখনো চলছে।
No comments:
Post a Comment