প্রাচীনকাল থেকে মমি নিয়ে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। অধিকাংশ লোকের মমি সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি স্কুলের ইতিহাস বইতে পড়া মিশরের পিরামিড ও তার ভিতরে সংগৃহিত মমির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই একটি বিশেষ মমি সমন্ধে জানবার আগে, জেনে নেওয়া যাক মমি সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ।
মমি শব্দটি মধ্যযুগের ল্যাটিন শব্দ মুমিয়া থেকে এসেছে, যা আরবী শব্দ মুমিয়া (مومياء) এবং পারস্য ফারসি ভাষা মোম (موم) থেকে আনা হয়েছে যার অর্থ হলো বিটুমিন।
অধিকাংশ গবেষকের মতে, মমির উৎপত্তিস্থল হলো প্রাচীন মিশর। তবে গ্রহণযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতারও এক হাজার বছর পূর্বে উত্তর চিলি এবং দক্ষিণ পেরুর চিনচেরাতে মমির সংস্কৃতি চালু হয়। ওই অঞ্চলের আধিবাসীরা সমুদ্রের মাছ খেয়ে জীবনযাপন করত। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে তাদের বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে প্রাচীন মিশরীয়রা মমি তৈরির একটি নির্দিষ্ট নিয়ম বের করেন। কয়েকটি ধাপে এই মমি বানানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হতো।প্রথমে মৃতব্যক্তির নাকের মাঝে ছিদ্র করে মাথার ঘিলু ও মগজ বের করা হতো। এ ক্ষেত্রে লোহা জাতীয় জিনিসের সহায়তা নেয়া হতো। তারপর মৃতদেহের পেটের বাম পাশে কেটে ভেতরের নাড়িভুড়ি বের করে ফেলা হত। এরপর শরীরের বিভিন্ন পচনশীল অঙ্গ যেমন:ফুসফুস, বৃক্ক , পাকস্থলী ইত্যাদি বের করা হত। এসব অঙ্গ বের করার পর আবার পেটে সেলাই করে দেয়া হত। এক্ষেত্রে তারা খুব সতর্কতা অবলম্বন করত। কারণ পেট সেলাই করতে গিয়ে যদি পেটের ভেতর হাওয়া ঢুকে যায়, তাহলে মৃতদেহ পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অতঃপর মৃতদেহ ও বের করা অঙ্গগুলোতে লবণ মেখে শুকানো হত। যখন সব ভালোভাবে শুকিয়ে যেত, তখন গামলা গাইন গাছের পদার্থ ও বিভিন্ন প্রকার মসলা মেখে রেখে দেওয়া হতো। চল্লিশ দিন পর লিনেনের কাপড় দ্বারা পুরো শরীর পেঁচিয়ে ফেলা হতো। এরপর তারা মমিগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখত।
প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত এই নিয়ে গবেষণা চলে আসছে। ইতিহাসে সুপ্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার কথা পড়েই আমরা মমির সাথে পরিচিত হয়েছি। এছাড়া বহু সিনেমাতেও মমির দেখা পাওয়া গিয়েছে। তবে মমির কথা বললে আমাদের সাধারণত তুতেনখামেনর অভিশপ্ত মমির কথাই মনে পরে। তবে আজ আমরা আলোচনা করব একজন নারীর রহস্যময় মমি নিয়ে। যার বর্তমান বয়স ২৬০০ বছর।
এই মমিটিকে পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে এই নারীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তাঁর সেই মৃত্যুর রহস্য সামনে এলো ২০২০ সালে। এই মমিটি মিশরের পশ্চিম থিবসের সুপ্রাচীন সমাধি থেকে ১৮৩৪ সালে উদ্ধার করা হয়েছিল। তারপর এটি উত্তর আয়ারল্যান্ডের হলিউড শহরের এক শিল্প সংগ্রাহক, থমাস গ্রেগ প্রচুর দাম দিয়ে কিনেছিলেন। তবে আয়ারল্যান্ডে এই মমিটি নিয়ে আসার পরেই সারা শহরে এক অদ্ভুত রকমের চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়ে যায়। ১৮৩৫ সালে থমাস গ্রেগ মমিটিকে নিজের কাছে না রেখে উলস্টার মিউজিয়াময়ে দিয়ে আসেন।
ওই বছরেই অর্থাৎ ১৮৩৫ সালের ২৭শে জানুয়ারী বেলফাস্ট ন্যাচরাল হিস্টরি মিউজিয়াম-এ মমির কফিনটি প্রথম খুলেছিলেন মিশর প্রত্নতত্ত্ববিদ এডয়ার্ড হিঙ্কস। এর পর তিনি সেই মিশরীয় মমিটির উপর গবেষণা শুরু করেছিলেন। সারকোফেগাসটি খোলার আগে তার ওপর খোঁদাই করা হায়ারোগ্লিফিক লিপি পড়ে তিনি বলেছিলেন ওই মমিটি একজন মহিলার। যার নাম তাকাবুতি। মৃত্যুর সময় এই মহিলার বয়স ছিল ২০-৩০ বছরের মধ্যে।
আরও জানা যায় তাকাবুতি একজন সম্ভ্রান্তবংশের মেয়ে ছিলেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে, তাকাবুতি কোনও সম্ভ্রান্তবংশের বউ বা রক্ষিতাও হতে পারেন। সে বিষয়টি ঘিরে এখনও জল্পনা রয়েছে। জানা গিয়েছে, তাকাবুতির বাবার নাম ছিল নেসপার। তিনি মিশরীয় দেবতা আমুন-এর পূজারি ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল তাসেনিরিক।
তবে রহস্য এখানেই শেষ নয় বরং আরও জটিলতা শুরু হয় সারকোফেগাস খোলার পর। মমিটিকে দেখা মাত্রই আঁতকে উঠেছিলেন পুরাতত্ত্ববিদ এডয়ার্ড হিঙ্কস। তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় এমন আশ্চর্যজনক মমি আগে কখনও দেখেননি তিনি। কুচকুচে কালো বর্ণের মুখ ও সোনালি রঙের চুল নিয়ে সকলকে অবাক করে দিয়েছিল মমিটি। সেই সময়কার সংবাদপত্র জুড়ে তাকাবুতিকে নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছিল।
জানা গিয়েছে, তাকাবুতি মারা যান মিশরে ২৫তম রাজবংশের রাজত্বের শেষের দিকে। গবেষকরা 'ফেস রিকন্সট্রাকশান' পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে দেখেছিলেন জীবিত অবস্থায় কেমন দেখতে ছিলেন তাকাবুতি। সেখান থেকেই জানা যায় অপরূপ সুন্দরী ছিলেন তাকাবুতি।
এর পরেই সামনে আসে আরও একটি রহস্য। তাকাবুতির মমিটির বামদিকের পিঠে একটি ক্ষত চিহ্ন লক্ষ্য করেন গবেষকরা। এই নিয়ে পুনরায় শুরু হয় গবেষণা। সেই গবেষণা শেষ হয় ২০২১ সালের জানুয়ারী মাসে। আধুনিক নানা পদ্ধতিতে মমিটির পরীক্ষা করা হয়েছিল, করা হয়েছিল তাঁর সিটিস্ক্যান এবং ডিএনএ টেস্ট। সেখান থেকেই গবেষকরা জানতে পেরেছিলেন তাকাবুতিকে খুন করা হয়েছিল। কুঠার দিয়ে নয়, বড় ছুরির মতন কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন হয়েছিলেন এই সুন্দরী।সম্ভবত, তাকে আক্রমণ করা হলে , তিনি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। তখন তার দিন কাঁধের উপর ধারালো চুরি দিয়ে মেরে তাকে খুন করা হয়। আরও জানা যায় তার হৃদপিন্ড চুরি করা হয়নি যেটা প্রাচীন কালে অনুমান করা হয়েছিল। এছাড়াও , তার দেহে একটি অতিরিক্ত দাঁত (যা শতকরা 0.2% লোকের দেখা যায় ) এবং একটি অতিরিক্ত ভার্টেব্রা ছিল ( যা শতকরা 2% লোকের হয়ে থাকে ।
তবে তাকাবুতি রহস্য এখানেই শেষ হয়নি। মমিটির ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট থেকে উঠে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। মিশরীয় ডিএনএ-এর সঙ্গে তাকাবুতির ডিএনএ-এর কোনওরকম মিল পাওয়া যায়নি। আশ্চর্যভাবে ওই মমিটির ডিএনএ-এর সঙ্গে মিল রয়েছে ইউরোপীয় ডিএনএ-এর। Mitochondrial Haplogroup H4a1 পাওয়া যায় যেটা ইউরোপিয়ানদের দেখা যায়।
তবে কি তাকাবুতিকে মিশরে এনে মমি করে সমাধিস্থ করা হয়েছিল? তাহলে মিশরীয় সেই দম্পতি তাঁর মা-বাবা হলেন কিভাবে ? এ বিষয় নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা কাটেনি। বিশ্বে নানা ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই রহস্যের গিঁট খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহিত
No comments:
Post a Comment