পার্লারের কাচের দরজা ঠেলে বেরোয় মিতা। কালকে পূর্ণিমা গেছে। চারিদিকে জ্যোৎস্নার আলোতে ফুটফুট করছে। একটু দূরেই সাইকেল রিক্সা স্ট্যান্ড। দু পা হেটে রিক্সাতে উঠতে যাবার সময়ে সামনের পান সিগারেটের দোকানের আলোতে দেখে কাছের লাইট পোস্টের নীচে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছে। মুখে মাস্ক লাগান থাকলেও তাদের মধ্যে কালো চশমা পরা ছেলেটিকে চেনে মিতা, এ পাড়ার সদ্য গজিয়ে ওঠা উঠতি মস্তান বিপ্লব।
ওদের সঙ্গে চোখচুখি হতেই, মিতা বুঝতে পারে ওদের দৃষ্টি মিতার সদ্য মেসেজ করা খোলা মসৃণ পিঠের উপর।ছেলেগুলো সবাই চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। আগেও এরকম ঘটনা অনেকবারই হয়েছে।উঠতি কিম্বা মধ্যবয়েসি মেয়েদের বাইরে বেরোলেই এরকম অনেক চোখের সামনে পড়তে হয়। তাই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে, রিক্সাতে উঠে পড়ে মিতা।
রিক্সা এখন মোটর-চালিত হলেও রিক্সার কাঠামো আগের মতোই রোগা-কাঠি , রিক্সাওয়ালাও তাই। কেবল একটি মোটর বসেছে। পা-তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে থাকে চালক, শোঁ শোঁ করে এগিয়ে যায় রিক্সা। মিতা খেয়াল করে পেছনে বাইক নিয়ে কয়েকটা ছেলে আসছে। তাহলে কি ওই ছেলেগুলো পিছু নিয়েছে? প্রশ্ন জাগে মনে। আঁচল টানে মিতা, পিঠ ঢাকে। ব্যাগ থেকে বার করে ফোন। আজ রোববার। রাত সাড়ে ন টার সময়েই রাস্তাঘাট কেমন ফাঁকা ফাঁকা।
সেই কখন ঢুকেছে পার্লারে! পৌনে সাতটা! এত ভিড়, লকডাউনের জন্যে দু মাস পরে পার্লার টা খুলেছে। তাছাড়া আজ অনেক কিছু করাবার ছিল। ওয়াইন ফেসিয়াল। ভ্রু প্লাকিং। ট্যান রিমুভাল। মুখে-হাতে-গলায়। পিঠে। এটা আগে করত না। টুবুলের জন্মের পরে আয়নার সামনে দাড়িয়ে আর অরূপের হাবভাব দেখে বুঝতে পারে বাচ্চা হবার পর তার শরীরের আর সেই রকম আগের মতন জৌলুস বা আকর্ষণ নেই। বুক পেট নরম থলথলে হয়ে গেছে। তাই ব্রেস্ট ফিডিং শেষ হবার পরেই ঠিক করে এবার একটু শরীরের যত্ন নিতে হবে। সেই কারণেই ছুটির দিনে টুবুলের পাশে অরূপকে রেখে মেসেজ করিয়ে নেওয়া। পার্লারের মেয়েটাই একদিন বলে, "দিদি এবার থেকে ট্যান রিমুভ করে দেব আপনাকে, দেখবেন জেল্লা কাকে বলে!" প্রথমবারেই ফল এল হাতেনাতে। যে অরূপ মুখ তুলেই চাইত না, সপ্তাহান্তেও ঘুমিয়ে পড়ত পাশ ফিরে, নজর এড়াল না তারও, " কী ব্যাপার মিতা, চকচক করছ! গ্ল্যামার বেড়ে গেল যে!"
বড় রাস্তা থেকে রিক্সাটা বা দিকে ঘুরে একটা সরু রাস্তাতে এসে পড়ল। এখানে কোন দোকান নেই, একেবারে শুনশান। শুধু এলোমেলো হাওয়া। জ্যোৎস্না পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। সামনেই মস্ত মাঠ। ফুটবল খেলা হয়। মাঠের ডানদিক দিয়ে রাস্তা। মাঠ পেরিয়ে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। দু'দিকে ঝোপঝাড়। মস্ত এক পুকুর। কেমন যেন গা ছম ছম করছে মিতার। দুটো বিশাল তেঁতুল গাছ। কিছুটা পথ পেরিয়ে তারপর মিশন কমপ্লেক্সের বাউন্ডারি শুরু। কমপ্লেক্সের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে ভয় নেই। ওখানে অনেকগুলো দোকান আছে।
কিন্তু এখনও বেশ খানিকটা যেতে হবে। মোটর-রিক্সা হলেও সময় নেহাৎ কম লাগবে না! বুকের ভিতর কেমন মোচড় দিচ্ছে, পেটের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করে। ফোনে অরূপকে ধরতে চায়। উফ, ফোন বন্ধ। টুবুলকে দুধ খাইয়ে দিয়ে এখন নিশ্চয়ই নেটফ্লিক এ সিনেমা দেখছে। ছুটির দিন এভাবেই কাটায় অরূপ। তিরিশ বছরের মিতা, গত দশ বছর ধরে দেখছে অরূপ কে, খুব ভাল করে চেনে। কলেজে পড়ার সময় সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি করত অরূপ, একবার ছাত্র রাজনীতি দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছে। কলেজ ছাড়ার পরেও অফিস থেকে বাড়ি ফিরে প্রতিদিন স্থানীয় পার্টি অফিসে যেত। বিয়ের পরে অবশ্য মিতার চাপে পড়ে পার্টি অফিস যাওয়া কমে গিয়েছিল। আর টুবুলের জন্মের পরে এখন অনেকটই কমে গেছে , পার্টির কোন বিশেষ মিটিং থাকলে বা ফোন করলে, একমাত্র তখনই অরূপ যায়।এক সময়ে দু জনেই চাকরি করত। কিন্তু বছর দু এক আগে টুবু পেটে আসার পরে মিতা ঠিক করে সে আর চাকরি করবে না , সংসারে মন দেবে, সন্তানকে মানুষ করবে। তাই ম্যাটারনিটি লিভের পরে অফিসে গিয়েই রেসিগ্নেশন লেটার দিয়ে চলে আসে।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল মিতা, বাইকের শব্দটা কানে আসতেই শিরশিরিয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক কারণে যতটা, তার থেকেও বেশি মোটরবাইক এর সরব উপস্থিতিতে। খেলার মাঠ বাঁয়ে রেখে এগিয়ে যায় রিক্সা।
'ভাই, একটু জোরে চালাও না!'
'এ তো ব্যাটারির রিস্কা বৌদি! জোরেই তো যাচ্ছি। যখন পা-রিস্কা ছিল, এত ইস্পিড ছিল না!'
ঘাড়টা আলতো ঘোরায় মিতা। প্রায় পাশে পাশেই আসছে একটা বাইক, চালাচ্ছে কাল চশমা পরা বিপ্লব, আরেকটা বাইক আসছে পিছনে। মোট চারটা ছেলে। বার বার ফোন করেও কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না অরূপের। অরূপ ফোন তুলছে না। ভেবে পায় না কি করবে ?? তাহলে কি পাশের বাড়ির ঘোষ বৌদিকে ফোন করবে ? কূলকিনারা পায় না মিতা।
বাইক দুটো রিক্সাকে টপকে এগিয়ে যায়। চলে আসে সামনে।মুখে মাস্ক লাগান থাকলেও বুঝতে পারে ছেলেগুলো তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে মিতা ফোন কানে দিয়েই থাকে। মনে হয়, ফোন খোলা আছে জানলে, হয়ত দু'বার ভাববে। অবশ্য আজকাল কেউই কোনও কিছু ঘটানোর আগে, ভাবে বলে মনে হয় না। ফোন কানে দিয়েই মিতা তীক্ষ্ণ চোখে জনমানবহীন রাস্তায় গতিবিধি নজর করতে থাকে ছেলেগুলোর।
রিক্সাওয়ালাটা লিকলিকে। সামান্য বাধা দিতে পারবে কিনা সন্দেহ! এতগুলো জোয়ানের সঙ্গে পারবেই বা কী করে! ব্যাটা এক ভঙ্গিতে বসে আছে পা-টা তুলে! রিক্সাটা দ্রুত চালিয়ে তাকে বিপন্মুক্ত করার কোনও ইচ্ছে কি ওর আছে?
'আরে ভাই একটু জোরে চালাও না!'
কানে ফোন নিয়েই বলে মিতা। যতটা গলা উঁচিয়ে বলতে চেয়েছিল, পারে না। অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে একটা আওয়াজ বেরোয়। রিক্সাচালক হাসে। ওর হাসিতে কোন অভিসন্ধি নেই তো, ভাবে মিতা। কী ব্যাপার! এই ব্যাটাও জড়িত নয় তো! ইচ্ছে করে আস্তে চালিয়ে সুবিধে করে দিচ্ছে জানোয়ারগুলোর!
মুহূর্তে গলা খাঁকারি দিয়ে, রুদ্ধ কণ্ঠ মুক্ত করে চিৎকার করে মিতা "জোরে চালাতে বলছি না তোমাকে ! হাসছ যে!"
"বৌদি, এ কি আর মোটর সাইকেল নাকি যে আপনাকে ঝড়ের বেগে পৌঁছিয়ে দেব!"
আবার হাসে চালক। সামনের বাইক দুটো জোরে বেরিয়ে যায়। কিছুটা দম নেয় মিতা। চলে গেল কি ওরা? ওর চিৎকার শুনতে পেয়েছে তাহলে? পেরিয়ে যায় খেলার মাঠ। চারপাশে এবার বুনো ঝোপ-ঝাড়। রাস্তায় আলো আছে। টিমটিমে।
আকাশে ফাটিয়ে চাঁদ উঠেছে। শুভ্র জ্যোৎস্না, পুলকিত যামিনী। মনে কোনও পুলক জাগে না মিতার। পেটের ভেতরের মোচড়ানিটা যদিও সামান্য কমেছে। আঁচলের ডগা দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে নেয়। এই হালকা শিরশিরে আবহাওয়ায় কেমন ঘেমে-নেয়ে উঠেছে সে!
ট্যান রিমুভ আজ না-করালেই হত! ঘন্টাখানেক আগেই হয়ে যেত তাহলে! তখন কি আর এত নিঝুম ছিল চারপাশ। আটটা আর দশটায়, মফস্বলে বেশ তফাৎ। পার্লারের মেয়েটা এমন জোর করল, বসে যেতেই হল। শীত গেল সদ্য, এখনই নাকি ট্যান-রিমুভাল বেশি দরকার। শীতে আমরা ছাতা ব্যবহার করি না, তাই ট্যান বেশি পড়ে। পিঠে তো সবার আগে করতে হবে। ওই খোলা জায়গাতেই তো রোদ লাগে বেশি। মেয়েটা এইসব ভুজুংভাজুং দিয়ে বসিয়ে দিল তাকে। ইস্ তখন ঘড়িটা যদি একবার দেখত! অরূপের কথা আবার মাথায় আসতেই অসম্ভব রাগ হয়। আচ্ছা আক্কেল এই লোকটার, রাত দশটা বাজে, বউ ফিরছে না, কোনও তাপ-উত্তাপ নেই!
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে তেঁতুলের ঝাঁকড়া ছায়া। ভূতের মতো দণ্ডায়মান। পুকুরের পাশ দিয়ে এগোয় রিক্সা। এরপর তেঁতুলতলা পেরিয়ে গেলেই ধড়ে প্রাণ আসবে। জয় বাবা লোকনাথ! ডানহাতের তর্জনিটা বার তিনেক কপালে ঠেকায়।কিন্তু পুকুর পেরোতেই সামনে এসে একটা পুরনো শিব মন্দির।
রিক্সাচালক ব্রেক কষে। ক্যাঁ-আ-আ-চ। দাঁড়িয়ে যায় রিক্সা। দাঁড় করাতে বাধ্য হয় চালক। তেঁতুলতলার সামান্য আগে, রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেই বাইক দুটো। বাইক থেকে নেমে চারটে ছেলে পথ আটকেছে।
বিস্ফারিত চোখে ওদের দিকে চেয়ে থাকে মিতা। চিৎকার করতেও ভুলে গেছে সে। অবশ্য চিৎকার করেও কি লাভ! এই তল্লাটে কোনও জনমনিষ্যি নেই।
তেঁতুলতলা পেরিয়ে কিছুটা যেতে হবে, তারপর মিশন কমপ্লেক্সের পাঁচিল। মূল ফটক আরও কিছুটা দূরে। রিক্সাচালককে ভাগিয়ে তাকে মুখ চেপে বাইকে তুলে নিলেই হল, নিশ্চল তেঁতুলগাছজোড়া ছাড়া কেউ সাক্ষী থাকবে না! নিজেকে ফিরে পায় মিতা। প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠে। বাঁচাও! বাঁচাও! কিন্তু ভীত, রুদ্ধ কণ্ঠ সাড়া দেয় না। ফ্যাসফ্যাসে একটা আওয়াজ বেরোয়। হেসে ওঠে ছেলেগুলো। কালো চশমা পরা বিপ্লব নামের ছেলেটা এগিয়ে আসে।
'মাচিস আছে কাকা?'
'আছে।'
পকেট থেকে একটা দেশলাই বাক্স এগিয়ে দেয় রিক্সার চালক।
ছেলেটা একটা কাঠি বার করে নিজের মুখের মাস্কটাকে খুলে সিগারেট ধরায়। ভুরভুর করে ধোঁয়া ছাড়ে। জ্যোৎস্নার আলোতে সিগারেটের ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠে যায়। ছেলেটা বা হাত দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসে মিতার সামনে। চোখ দিয়ে আপাদমস্তক চাটে ছেলেটা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার শরীরের দিকে,." কি বৌদি, ভয় পেয়েছেন ? চিৎকার করুন। দেখি কে আপনাকে বাঁচাতে আসে। দেখি তো কত গলার জোর আপনার।" চোখের কালো চশমাটা খুলে পাশে ফেলে, লাল চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে ওঠে, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় একটা শয়তানের হাসি। এবার বোতামগুলো একটা একটা করে খুলে, জামাটা ছুড়ে ফেলে মাটিতে। প্যান্টের পকেট থেকে একটা ফোল্ডিং ছুরি ফেলে জামার উপর, "কি বে শালা, দূর থেকে দাড়িয়ে শুধু দাঁত বার করলে চলবে ? এরপর তো পেরসাদ খেতে আসবি । বলি পেয়াজের খোসাও কি আমাকেই ছাড়াতে হবে না কি শালা ?
ছেলেটার মুখ থেকে ভক ভক করে সস্তা মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। মিতার হাত পা শুকিয়ে যাচ্ছে, গলা থেকে হাজার চেষ্টা করেও কোন শব্দ বার করতে পারছে না। আঁচল দিয়ে আর একবার জড়িয়ে নেয় নিজের সমস্ত শরীরকে, লজ্জাকে, মনকে।এক মনে শুধু মনে মনে লোকনাথ বাবাকে ডাকতে থাকল আর ছেলেটার গতিবিধি নজর করতে লাগল।
ততক্ষণে প্যান্টের বেল্ট টাও খুলে পাশে ছুড়ে ফেলে বিপ্লব, "এস সুন্দরী, ওদের কাউকে দরকার নেই। " বলে হো হো করে হাসতে মিতার দিকে হাত বাড়ায় বিপ্লব।
আর ঠিক সেই সময়ে, মিতা লক্ষ্য করে, একটা ছেলে ছুটে এসে বিপ্লবের কানে কানে কি যেন বলে, শুনতে পায় না মিতা। একটা কথাই কানে এলো, " শালা, আগে এই কথাটা বলতে পারিস নি। এতটা পথ তাড়া করে এসে এই জ্যোৎস্না রাতের এত সুন্দর পরিবেশে মুরগীটাকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দিতে হল।"
মিতার দিকে তাকিয়ে বলল,"বৌদি, আপনার কপাল খুব ভাল আজকে। সামু আপনাকে চিনতে পেরেছে যে আপনি অরূপদার স্ত্রী। অরূপ দা আমাদের পার্টির বড় দাদা, তার কাছেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি। এই বিপ্লব মস্তান আরুপদা কে গুরু বলে মানে আর এ দুনিয়াতে যদি একজনকেও শ্রদ্ধা করে, সেটা অরূপ দা কে। শুধু সেই জন্যেই আপনি আজ বেঁচে গেলেন। আর একটা কথা মনে রাখবেন, আড়াইমাস লকডাউন থাকার পরে সবে দোকান পাট খুলতে শুরু করেছে। দিনকাল কিন্তু খুব খারাপ। লোকের হাতে করোনার জন্যে পয়সা নেই। লুটপাট বেড়ে গেছে। রাত্রে একা বেরোবেন না। কথাগুলো মাথায় রাখবেন" বলে পাশে সরে দাঁড়ায়।
শেষ-মাঘের হাওয়ায় তেঁতুলপাতার মতো তিরতির করে কাঁপতে থাকে মিতা। মনে মনে বাবা লোকনাথ কে প্রণাম জানায়। কিন্তু ছেলেটা কি বলে গেল। এই সব নেশাখোর দুশ্চরিত্র ছেলেরা অরূপের চেলা। এই সব পশুগুলোকে দিয়ে নেতারা পার্টি চালায়। ছি: …ঘিনঘিন করে ওঠে গোটা শরীর। বমি পায় তার।
রিক্সাচালক চাবি ঘুরিয়ে বেগবান করে বাহন। বাইকটা চালু করে ভটভটিয়ে চলে যায় ছেলেগুলো।
ফোন বাজে। অরূপ। ফোন ধরে না মিতা। কেটে দেয়।
কমপ্লেক্সের মস্ত ফটকের সামনে মিতাকে নামিয়ে রিক্সাচালক বলে, 'বৌদি খুব ভয় পেয়েছিলেন, না? ওদের চিনি আমি। আমাকেও চেনে ওরা। রড আছে আমার গাড়িতে। বেশি ট্যান্ডাইম্যান্ডাই দেখলে মাথা চ্যালা করে দিতাম না!'
মুখ দিয়ে শব্দ বেরোয় না মিতার। ভাড়া চুকিয়ে প্রায়-ছুটে ঢুকে যায় কমপ্লেক্সের ভিতরে। লিফটে ওঠে তিনতলায়। বেল বাজায়। তিনবার বাজানোর পর দরজা খোলে অরূপ। ঘরে ঢুকে হুড়মুড়িয়ে। কতক্ষণ ধরে সে এই ঘরেই আসতে চেয়েছে। অবশেষে এসে পৌঁছায় তার নিজের ঘরে। এই সাত আট মিনিটের পথ মনে হয় কত লম্বা, রাস্তা যেন ফুরাতেই চাইছিল না। দম নেয় মিতা…..
'ফোনটা বন্ধ রেখেছ কেন?'
"তুমি এত ঘামছ কেন মিতা! এনিথিং রং!"
"একজন বাড়ির বাইরে আছে! ফোনটা বন্ধ রাখার জিনিস নয়, এটা তোমাকে কে বোঝাবে!" থর থর করে কাঁপতে থাকে মিতা।
মুখের থেকে মাস্ক টা খুলে ছুড়ে ফেলে ঘরের কোণে, চটিটা ছেড়ে বেডরুমে ঢুকে যায় মিতা। হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অরূপ।.
মনে হয় যেন আগুনের হলকা ছুটে আসছে তার দিকে । কি করবে বুঝতে না পেরে,ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল নিয়ে ঘরে ঢুকে ফ্যানটা ফুলস্পীদে চালিয়ে বিছানায় বসে মিতা। দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয়। চোখ বুজে থাকে । আজকে যে কি হতে পারত, সেটা ভেবে হাত পা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। মনে হয় একদল নেকরে তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে আছে আর একটু একটু করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে।কিন্তু গলা থেকে আওয়াজ বের হয় না।
ঘরে ঢোকে অরূপ।
"আরে ডারলিং, কী পিঠ বানিয়েছ ডিয়ার! সানি লিওনি আমার!" বলতে বলতেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মিতার ঘাড়ে মুখ গুঁজে জিভ বোলাতে থাকে পিঠে।
" ছাড়ো তো, ছেড়ে দাও আমাকে….. তুমি আমার ধারে কাছে আসবে না" ঠেলে সরিয়ে দেয় অরূপকে।
"কি হয়েছে মিতা??"
"জিজ্ঞাসা করছ কি হয়েছে, আজ লোকনাথ বাবার কল্যাণে বেঁচে বাড়ী ফিরেছি। শেষ হয় যেতাম তোমাদের ওই পার্টির পোষা গুন্দাগুলোর হাতে। লজ্জা করে না ? এই শয়তানগুলো তোমাদের পার্টির ক্যাডার। ছি: ঘেন্না করছে এটা ভাবতে যে তুমিও ওদের সঙ্গে আছ। ছি :"
" শান্ত হও মিতা, আমায় বল কি হয়েছে" এগিয়ে আসে অরূপ।
"আজকে আমি তোমার স্ত্রী বলে পার পেয়ে গেছি কিন্তু শিউরে উঠছি এটা ভেবে যে যদি আমার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে থাকত বা ওদের মধ্যে একটা ছেলে যদি আমায় চিনতে না পারত, তাহলে কি হত ? ওই জনোয়ারগুলো তো তাহলে তাকে ছিড়ে খেয়ে শেষ করে দিত" কাদতেঁ থাকে মিতা "কেউ জানতেও পারত না কে করেছে? আর পরের দিন সকালে যদি খবর টা পেপারে ছাপা হত, সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক পার্টিগুলোর মধ্যে শুরু হয় যেত ব্লেমগেম আর কাদা ছোড়াছুড়ি" আমার ভাবতে ঘেন্না লাগছে যে তুমিও এই পার্টির একজন।"
" তুমি শুধু শুধু পার্টিকে দোষারোপ করছ, ওটা ওর ব্যক্তিগত জীবন…."
"কখনোই না। ছেলে যদি দোষ করে, তার দায় বাবা মা কে নিতে হয়… তাছাড়া আমি একটা জিনিষ এখনও বুঝতে পারছি না যে তুমি কেন ওই গুন্ডা বিপ্লব টাকে আড়াল করতে চাইছ ???"
"কে, বিপ্লব??"
"জান, ও মদ খেয়ে চুড় হয় তোমার বিবাহিত স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে এসেছিল। আমার ভাবতে ঘেন্না করছে, ছি: ছি:"
সামনে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে মিতা। কাঁপতে থাকে। ঘিনঘিন করে ওঠে গোটা শরীর। ছেলেগুলোর চোখের সেই হায়নার মত লোভী দৃষ্টি কথা মনে পরতেই বমি পেল আবার।পরক্ষনেই তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে উঠে পড়ে। আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ওয়াইন ফেসিয়াল করালেও মুখে যেন রাজ্যের কালি। সারা শরীরে ছোপ ছোপ করে কারা যেন কাদামাটির প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে। চোখ দিয়ে অপবিত্র করে দিয়েছে তার শরীরকে মনকে, এই কয়েক মিনিট কেড়ে নিয়েছে সমস্ত জৌলুস, পবিত্রতা।
দৌড়ে ঢুকে যায় বাথরুমে।
এখানেই হয়তো শেষ হতে পারত, কিন্তু পরের দিন সকালের খবরের কাগজে প্রকাশিত একটা ছোট্ট ঘটনা না বললে, এটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
গড়িয়ার নরেন্দ্রপুর অঞ্চলে মিশনের পাঁচিলের বাইরে পুরোনো শিব মন্দিরের সামনে বিবস্ত্র অবস্থায় এক মহিলার মৃতদেহ পুলিশ উদ্ধার করে। খবরে প্রকাশ কাল রাত সাড়ে দশটা নাগাদ এক সদ্য বিবাহিত দম্পতি রিকশা করে বিয়ে বাড়ী থেকে বাড়িতে ফেরার পথে কিছু দুষ্কৃতি র দ্বারা গন ধর্ষিত হন। স্বামী বাধা দিতে গেলে তাকে মারধর করা হয়। সেই অবস্থায় ওই ব্যক্তি পুলিশে খবর দিলে , পুলিশ ওই মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার করে। পুলিশ খোজ চালাচ্ছে।
No comments:
Post a Comment