অবশেষে পাঁচশ টাকাতে রফা হল। অজিতের ভীষণ প্রিয় ছোটবেলার লাল সাইকেলটা বিক্রি করে দিতে হল। যে বাচ্চা ছেলেটা বাবার হাত ধরে সাইকেলটা নিতে এসেছিল, ভীষণ খুশিতে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল সেই লাল সাইকেলটায়।উঠে ছোট্ট হাতে ক্রিং ক্রিং করে বাজাতে আরম্ভ করল হাতলে লাগান বেলটা। মনে পড়ে গেল বাবা যেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে এই সাইকেলটা কিনে নিয়ে এসেছিলেন, কি আনন্দ হয়েছিল অজিতের। তখন কত আর বয়েস হবে তার, বড়জোর সাড়ে তিন কি চার।কয়েকদিন তো সকাল সন্ধ্যায় শুধু ঘুমানোর সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাদিন ওই সাইকেলটায় চড়ে বসে থাকত। ভীষণ খুশি হয়েছিল বাবার উপর।

শুধু সাইকেল কেন, ক্যানসার ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত বাবার কাছে কোনদিন তাকে কিছু চাইতে হয়নি। কিন্তু গত একবছরে বাবার যত টুকু জমান পুঁজি ছিল, পুরোটাই প্রায় শেষ। বাকি পড়তে শুরু করেছে সমস্ত জায়গাতে। শুধু এই পাড়ায় এতবছরের সুনামের সঙ্গে থাকার সুবাদে লোকেরা এখন পর্যন্ত বাড়ি এসে তাগাদা মারতে শুরু করেনি। ওদিকে বাবার চাকরি আর দুদিন আছে।আজ 29 তারিখ, অফিসিয়ালি এই মাসের 31 তারিখ পর্যন্ত আছে। কিন্তু বাবার ছুটি সব শেষ, উইদাউট পে হতে হতে এখন আর মাইনের কোন টাকাই আসে না। এই তেইস বছর বয়সেই একদিকে বাবার চিকিৎসা অন্যদিকে সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে বাবার অফিসের থেকে কেটেকুটে মাইনের কিছু টাকা দিয়ে হসপিটালে প্রথমে আই সি ইউ, তারপর জেনেরাল বেড আর এখন টাকা দিতে না পারার জন্য তিন তলার সিঁড়ির মাথায় একটা বেড়ে শুইয়ে রেখেছে।
সাইকেল বিক্রির টাকাটা হাতে পেয়েই প্রথমে ছুটল কসবা বিজন সেতুর মুখের রেমিডি মেডিকেল ওষুধের দোকানে। হসপিটালের ডাক্তার এই স্টেরয়েডটা দিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখতে চান। ওষুধটা নিয়ে বেরোচ্ছে পিছন থেকে দোকানের মালিক বিজন সাহার ডাকে পিছনে ফিরে তাকায়,"কি অজিত, বাবা কেমন আছেন ? "
"অবস্থা খুব একটা ভাল নয় কাকু, এই ওষুধটা দিয়ে হসপিটালের ডাক্তার মিশ্র একবার দেখতে চান।"
"দেখ কেমন থাকেন ? ও শোন, তোমার আজকের টাকাটা বাদ দিয়ে এখনো প্রায় আড়াই হাজার টাকা বাকি। বুঝতেই তো পারছ, পাড়ার দোকান। কটা টাকার ওষুধ বিক্রি হয় ? তার উপরে ওষুধের দোকানে বাকি চলেনা। নেহাত তোমাকে পাড়ায় ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি, তোমার বাবা খুবই ভালো মানুষ। সেইজন্য তোমাকে বাকিতে ওষুধ দিই। দেখ যদি অন্তত আরও হাজার দেড়েক টাকা জমা করতে পার।"
অজিত মাথা নেড়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনতে পায় দোকানের মালিক বিজন সাহা কর্মচারীদের বলছে ,"এই ছেলেটা টাকা না দিয়ে ওষুধ নিতে আসলে, বলে দিবি ওষুধ নেই। আর বাকিতে দেওয়া যাবে না"।
দোকান থেকে বেরিয়ে ইনজেকশন দুটো নিয়ে ছুটতে থাকে ওদের ক্লাবঘরের দিকে। যদি সন্দীপকে পায়, তাহলে ওর হাত দিয়ে হসপিটালে ইনজেকশন দুটো পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। সকাল থেকে ছোটাছুটি করতে করতে আর হসপিটালে যেতে ইচ্চা করছে না।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিকেলে ডাক্তারবাবুর কথাগুলো মনে পড়ে গেল।'এই ইনজেকশন দুটো দুদিন রাতে দিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি, যদি কোন উপকার হয়.. '
প্রায় ছুটতে ছুটতে ক্লাবে এসে দেখে সন্দীপ একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। ওকে দেখতে পেয়ে বলে, "কি রে কাকু কেমন আছেন ?"
"ওই একইরকম। ডাক্তাররা একটা শেষ চেষ্টা করতে চায়। এই ইনজেকশনটা যদি নিতে পারে, তবে হয়ত এ যাত্রা বেঁচে যাবে। সন্দীপ, তুই ওই নার্সিং হোমের সামনে দিয়েই তো যাবি। এটা হসপিটালে দিয়ে দিবি প্লীজ..? হসপিটালে গেলেই ওরা টাকা দেবার জন্য তাড়া দিচ্ছে। কাল 31 তারিখ, বাবার চাকরির শেষ দিন। ফাইনাল সেটেলমেন্ট এর চেক পরশু পেলে, তখন টাকা জমা করে দেব। এখন যত কম গিয়ে পারি। কালকে তো যেতে হবেই। তবু যতটা দূরে দূরে থাকা যায়..."
"হ্যা, এতে প্লিজ বলার কি আছে ? ওটা আমার পথেই। যাবার সময় দিয়ে দেব। ?"
"জানিস,অনেকদিন পরে আজ ক্লাবে সমীরণ এসেছিল। ক্লাসের সমীরণকে মনে আছে তো ? কি কপাল দেখ, সমীরণের।ক্লাসের লাস্ট বয় আজ সরকারী চাকরি করে চোখের সামনে দামী জামা কাপড় মোবাইল বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমরা পড়াশুনা করে কি করলাম বলত ?"
"পেল কি করে সরকারি চাকরি ?"
"মেসোমাসাই মারা গিয়ে ওর কপাল খুলে গেছে। মেসোমাসাই সরকারি চাকরি করতে করতে মারা যান।সেই জন্য বাবার চাকরিটা ও পেয়ে গেছে।আর তাই দিয়েই এত ফুটানি..."
"ছাড়। ওই ইনজেকশনগুলো দিয়ে দিস। অনেক রাত হল।চলি"
বাড়িতে ঢুকতেই মা আর বোন জিজ্ঞাসা করে '"বাবা কেমন আছে ?"
"ওই একই রকম" বলে নিজের ঘরে চলে যায়।
কিছুতেই বিছানায় শুয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। ওই সমীরণের কথা শোনার পর থেকেই, মাথায় আগুন জ্বলছে। ওর কি যোগ্যতা আছে এরকম একটা চাকরি পাবার ? বাপ না মরলে তো রাস্তায় জুতো সেলাই করার যোগ্যতা পর্যন্ত নেই। সে কিনা এক লাখ টাকার বাইকে চেপে তাকে জ্ঞান দিয়ে গেল ?
একটা কথা হঠাৎ সন্দীপের মনে হয়, ' বাবা যদি কালকের মধ্যেও মারা যায়, তার একটা হিল্লে হয়ে যাবে...' কম্প্যাশনেট গ্রাউন্ডে ওর চাকরি হয়ে যাবে।আজ যদি বাবা মারা যান, বেঁচে যাবে তিনটে জীবন সে মা আর বোন।সন্দীপের কথাটা নির্মম হলেও সত্যি।এই মানুষগুলোর কি অধিকার নেই বেঁচে থাকার ? মায়ের কি অধিকার নেই চিকিৎসা পাবার, শেষ জীবনে দুটো ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার ? ছোট বোনটার কি অধিকার নেই বিয়ে করে একটা সুন্দর সংসার করার ? আর তার কি এই ভাবেই সারাটা জীবন কাটাতে হবে সবার কাছে হাত পেতে।এটুকু চাওয়া কি খুব বেশি চাওয়া ? যে মানুষটা যেতে বসেছে সে যদি একদিন আগে চলে যায়, তাহলে এতগুলো মানুষ বেঁচে যাবে । চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের যন্ত্রণাক্লিস্ট মুখ, বোনের অসহায় মুখটা । আস্তে আস্তে কান মাথা সব গরম হয়ে উঠতে থাকে। হ্যা হ্যা বাবার মৃত্যুটা আজ হলে বেঁচে যাবে এতগুলো প্রাণ।ক্রমে ক্রমে নিশ্চিত হতে শুরু করে অজিত।কিন্তু কি ভাবে ? জন্ম মৃত্যু তো কারও হাতে নেই ?
কিন্তু এরপরেই মনে হয় ব্যাপারটা তো তার হাতেই রয়েছে। ওই যে অক্সিজেন সিলিন্ডারের নলটা ? ওর গলায় যে চাকতিটা আছে, সেটা ঘুরিয়ে কিছুক্ষনের জন্য গ্যাস বেরোনো বন্ধ করে দিলেই তো বেঁচে যেতে পারে তিনটে জীবন। কিন্তু এটা তো খুন, পিতৃহত্যা। সঙ্গে সঙ্গে মনের ভিতর লুকিয়ে রাখা তার আরেকটা স্বত্বা বলে ওঠে,'না এটা খুন হবে কেন ? শুধু একটা অবশ্যম্ভাবী ঘটনাকে কিছু সময়ের জন্য এগিয়ে নিয়ে আসা। বাবা জানতে পারলে পরিবারের এতগুলো লোকের কথা ভেবে নির্ঘাত না বলত না। এই যুক্তিটা মনে ধরল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল গাঙ্গুলি কাকুর সকালে বলা সংস্কৃত শ্লোকটা,
"নন্যানি সংযাতি নবানি দেহি।
নৈনং ছিনদন্তী শস্ত্রানি নৈনং দহতি পাবকঃ"-
আত্মা তো অবিনশ্বর, তাকে কেউ খুন করতে পারে না। অজিতও পারবে না। শুধু বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে তাকে ত্বরান্বিত করতে পারে। হ্যাঁ না এই মানসিক টানাপোড়েন করতে করতে সে ঠিক করে এ কাজ তাকে করতেই হবে। তাহলেই এতগুলো প্রাণ বাঁচবে।বাবা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
নার্সিংহোমের গেটের কাছে যখন পৌঁছাল অজিতের ঘড়িতে ঠিক চারটে। তার বাবা আজ বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সরকারি কর্মী। হাতে মাত্র এক ঘন্টা সময় মানে মাত্র ষাট মিনিট।চারটে থেকেই ভিসিটিং আওয়ার শুরু। গেট দিয়ে ঢুকতেই কেউ একজন তাঁকে ডাকল,"এই যে শুনছেন.."
"আসছি..." বলে ভিড়ের মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে তিন তলায় ল্যান্ডিং এ পৌঁছে যায় সে। এখানে মাত্র একজন পেশেন্ট, অজিতের বাবা। বাবা ঠিক আগের মতই শুয়ে আছেন। সবুজ চাদরে গলা পর্যন্ত ঢাকা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, চোখের পাতা বোজা। শুধু অক্সিজেন যাবার জলভর্তি কাঁচের বোতলের বুদবুদ গুলো জানান দিচ্ছে, শুয়ে থাকা মানুষটার দেহে এখনো প্রাণ আছে।অজিতের চোখ গেল পাশে থাকা সিলিন্ডারের গোল চাবিটার দিকে। সে চাবিটাকে স্পর্শ করল।আর দেরি করা যাবে না। কোথা থেকে বুক ফেটে কান্না এল বাবার নিরীহ মুখটার দিকে তাকিয়ে। মনটাকে শক্ত করার চেস্টা করল। এই কাজটা তাকে করতেই হবে। আর সময় নেই, এখনই।চাবিটা ঘোরাবার আগে একবার সিড়িটার দিকে দেখে নিল, না কেউ নেই। একবার পাশের জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল তার বিক্রি করে দেওয়া সেই লাল সাইকেলে বসে বাচ্চাটা সাইকেল চালানো শিখছে আর তার বাবা সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ধরে রেখে বলছেন,"পড়বি না পড়বি না। এই তো আমি ধরে আছি।"

অজিত চোখ সরাতে পারেনা। তাকিয়ে থাকে জানালা দিয়ে। সাইকেলটা কিছুটা এগোবার পরই ভদ্রলোক ছুটতে ছুটতেই হাত সরিয়ে নেন। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা ছেলেটা ভয়ে চিৎকার করে ওঠে,"বাবা আমাকে ছেড়ে দিও না, ছেড়ে দিও না। আমি পড়ে যাব......"
অজিতের খেয়াল নেই কখন তার হাত খসে গেছে সিলিন্ডারের চাবির থেকে। চোখ ভরে গেছে জলে। নিজের অজান্তেই চিৎকার করে ওঠে,"বাবা আমাকে ছেড়ে দিও না... আমি পড়ে যাব"
ঠিক সেই মুহূর্তে, কিসের যেন স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠে। বাবার শীর্ন হাতটা তাকে ছুঁয়েছে। বাবা চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে। দোতলা থেকে ছুটে আসেন একজন নার্স, অজিতের দিকে তাকিয়ে বলেন,"কি হয়েছে, এরকম চিৎকার করে উঠলেন কেন ?"
"না, মানে এমনি..."
"কাল রাতের ইনজেকশনে কাজ হয়েছে। দুপুরেই চোখ খুলেছেন উনি। ডাক্তারি শাস্ত্রে এটাকেই বলে মিরাকেল। এ যাত্রায় মনে হয় ওনাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন..."
অজিতের হাতটা তার বাবা ধরে আছেন। মুখে মুচকি হাসির একটা হালকা আভাস। দুজনের চোখ দিয়েই গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরে যায় সেই ছোটবেলায়। ছোট্ট লাল সাইকেলটা চালাচ্ছে অজিত। বাবা হ্যান্ডেলটা ধরে তার সঙ্গে ছুটছেন।অজিত বার বার ভয়ে চিৎকার করে বলছে, "বাবা, আমাকে ছেড়ে দিও না, আমি পড়ে যাব। "
বাবা বার বার তার সাইকেলের সঙ্গে ঘামতে ঘামতে ছুটে চলেছেন আর বলছেন, "পড়বি না, পড়বি না। আমি তোকে পড়তে দেব না, এই তো আমি আছি, ভয় নেই..."
No comments:
Post a Comment