সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে কেন ? সব কিছু একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে আসছে। চারিদিকে অন্ধকার করে আসছে। তমশার পা থেকে শুরু করে সমস্ত শরীরটা যেন একটু একটু করে অবস হয়ে আসছে। কিন্তু চারপাশের আলো তো সে এখনও দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখ খুলে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে, বন্ধ হয়ে আসছে চোখ। তবে কি চোখ খুললেই সব ঠিক হয়ে যাবে ? এটা কি কোন দুঃস্বপ্ন ? তবে কি সে আর বেঁচে নেই ? মারা গেছে ? আরে এই তো তাপস। ওই তো তাপস একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাঁসছে। জায়গাটা কি সুন্দর। কিন্তু ও তো তার সঙ্গেই ছিল। তাহলে এতক্ষন কোথায় ছিল তাপস ? কখন এল ? প্রশ্নগুলো ভীড় করতে থাকে মাথার মধ্যে।
একটু একটু করে সব কিছু মনে পড়ছে।মা বাবা আর সে, এই ছিল তাদের পরিবার। তিনটে মুখ ভেসে উঠছে চোখের সামনে।মায়ের কোলে সে। সন্ধ্যায় জন্ম হয়েছে বলে নাম রাখা হল তমশা। একটু একটু করে বড় হল,কাঁদতে শিখল, হাঁসতে শিখল, প্রথমে স্কুল, তারপরে কলেজ , পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হল। স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে স্কুলের চাকরিটাও পেয়ে গেল। একটু একটু করে জীবনের সাফল্যের সোপান বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। ব্যর্থতা ও অসাফল্যতা এল সাফল্যতার হাত ধরে। শিখতে শুরু করল জীবনে বাধা আসবেই। একটু একটু করে সমস্ত বাঁধা বিপত্তি উত্তীর্ণ হতে লাগল। এগিয়ে চলল জীবনে। স্কুলের চাকরিটা পাবার পর থেকেই বাবা মা উঠে পড়ে লেগেছিলেন এক সৎপাত্রের খোঁজ করতে। বছর খানেক বিভিন্ন ম্যাট্রিমনি সাইটে খোঁজ করে অবশেষে তাপসের সন্ধান পাওয়া গেল।
এরপর দুই বাড়ির কেউই আর দেরী করেন নি। মাস ছয়েক আগে ওদের চার হাত এক করে দেওয়া হল। তারপর থেকে যাব যাব করেও ওরা ঘুরতে যেতে পারেনি। তাপসের না কি পাহাড়ে গেলে ফাঁড়া আছে , এদিকে তমশার ভীষণ ইচ্ছা পাহাড়ে বেড়াতে যাবার। অবশেষে, শ্বশুরবাড়ীর গুরুদেবকে দিয়ে ফাঁড়া কাটিয়ে ওরা ঘুরতে আসে হিমাচল প্রদেশের ডালহৌসি, ধর্মশালা তে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতে বিভোর হয়ে চোখের লহমায় কেটে গেল সাতটা দিন। ওদের ফেরত আসার ট্রেনের টিকিট পাঠানকোট থেকে, সেইমতই ওরা আসছিল গাড়িতে। একের পর এক পাহাড় পেরিয়ে দুর্গম পাহাড়ি রাস্তার রোমাঞ্চকর প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে করতে পাহাড় থেকে নীচে নেমে আসছিল।
আকাশটা শুরু থেকেই মেঘলা ছিল কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে বৃষ্টি নামবে, কেউ বুঝতে পারে নি, তার উপরে ট্রেনের টিকিট আগে থেকে কাটা। তাই পাঠানকোট পৌঁছনোর তাঁরাও ছিল। পাঞ্জাবী অল্পবয়সী ড্রাইভার সরু পাহাড়ি রাস্তায় ভালই চালিয়ে আনছিল। একদিকে বিশাল উঁচু পাহাড় আর অন্যদিকে গভীর খাদ। গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝেই ব্লাইন্ড টার্ন। হঠাৎ করেই সামনে থেকে গাড়ী চলে আসছিল। এইভাবেই গাড়ী পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। শুরু হল প্রচন্ড বৃষ্টি। হঠাৎ সামনে থেকে আসা একটা গাড়িকে কাটাতে গিয়ে চাকা স্লীপ করে গাড়ী গিয়ে ধাক্কা মারল খাঁদের দিকের সরু পাথরের দেওয়ালে।একটা বিশাল জোরে শব্দ, গাড়ীর দরজাটা ভেঙ্গে গেল, মাথায় একটা প্রচন্ড আঘাত পেলাম, চারিদিকে অন্ধকার, এর পর আর কিছু মনে নেই …
সব কিছু কি তাহলে এখানেই শেষ ?তবে কি মা বাবা আত্মীয় পরিজন বন্ধু বান্ধব কারও সাথে আর দেখা হবে না তার ? সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি। হে ভগবান, সে তো এখনই মরতে না। এই সুন্দর পৃথিবীর কিছুই তো দেখা হল না । সব সাধ ইচ্ছাই তো অপূর্ণ রয়ে গেল । মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু চোখ দুটো তো বন্ধ হয়ে আসছে। এটা কেন হল ? তাহলে কি এত দিনে তিলে তিলে অপেক্ষা করছিলাম এই দিনটার জন্য ?
ছোটবেলায় দাদু রোজ একটা করে গীতার শ্লোক বলে তার মানে বুঝিয়ে দিতেন। তার মধ্যে থেকে একটা শ্লোক বার বার মনে আসছে এখন:
বাসাংসি জীর্নানি যথা বিহায়
নবাণি গৃহনাতি নরোহপরানী
তথা শরীরানি বিহায় জীর্না
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী
মানুষ মারা যায় কিন্তু আত্মার কোন বিনাশ নেই। সে এক দেহ থেকে অন্য একটি দেহে প্রবেশ করে। তাহলে কি সে নতুন কোন দেহে প্রবেশ করতে চলেছে ….
আরে সামনে এটা তাপস না ? হাসিমুখে তাপস হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছে তো!!!! তাপস একেবারে কাছে চলে এসেছে। দাঁড়াও তাপস, আসছি। একটু অপেক্ষা কর…..
কষ্ট করে ভারী হয়ে আসা চোখের পাতাটা একবার খোলার চেষ্টা করল তমশা। সামনে বিশাল আকাশটা যেন আজ গ্রাস করতে আসছে।গাড় নীল রঙের।তার দেহটাকে একটা সুন্দর খাটের উপর শুইয়ে রাখা। একি পাশের বাড়ীর বৌদি তার মুখে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে দিচ্ছে কেন ? তার চোখের থেকে দু এক ফোঁটা জল মুখের উপর পড়ল। পাশের থেকে তমশা t মা বাবার কান্নার শব্দ শুনতে পেল। একে একে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই দূর থেকে দেখে যাচ্ছে। তাদের দেখে কথা বলতে ইচ্ছা করছে, ছুঁটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে কিন্তু শরীরটা ভীষণ ভারী হয়ে গেছে। ভীষণ ইচ্ছা করছে মায়ের কোলে মাথা রেখে ছোটবেলার মত একটু ঘুমাতে। কেউ কিছু বললে বাবার বুকে মুখ গুজে যখন কাঁদত, তখন বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতেন। আজও তমশার ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে বাবার বুকে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে বলতে " ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে, বাবা…"। কিন্তু নাড়াচাড়া করার ক্ষমতা নেই। শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ গুলো বিন্দুমাত্র নাড়াবার আর শক্তি নেই। মৃত্যুর কাছে এতটা অসহায় কেন মানুষ ? বার বার এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে।
চোখটাকে আর খুলে রাখা যাচ্ছে না। সবাই বলত, তার চোখদুটো না কি খুব সুন্দর!! এই সুন্দর চোখদুটো আর কোনদিন খুলবে না। বড্ড শান্তি লাগছে। এত শান্তি মনে হয় কোন দিন পাইনি। কে যেন এসে সারা শরীরের উপর একটা নামাবলী চরিয়ে তার উপর একটা গীতা বুকের উপর রেখে গেল। চারি দিক থেকে সুন্দর ধূপের গন্ধ নাকের উপর দেওয়া তুলসী পাতাটা ভেদ করে নাকে আসছে।এ কি ওরা কোথায় নিয়ে চলেছে ? মা বাবার কান্নার শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। চারিদিক থেকে পাড়ার কয়েকজন দাদা এসে তার খাটটাকে নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিল। চারিদিক সবাই বলে উঠে "বল হরি, হরি বোল… বল হরি হরি বোল..
No comments:
Post a Comment