বি কম পার্ট টু পরীক্ষার শেষ দিনে প্রতীক বুঝতে পেরেছিল এটাই ওর জীবনের শেষ পরীক্ষা। বাবা স্থানীয় লেদ ফ্যাক্টরিতে কর্মরত অবস্থায় একটা একসিডেন্টে মারা যান প্রতীকের ঠিক মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে। তারপর থেকে মাকে সঙ্গে নিয়ে দারিদ্রতার মধ্যে অতি কষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে গ্রাজুয়েট হওয়াটাই তার কাছে স্বপ্ন ছিল। মায়ের দোমড়ানো মোচড়ানো মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল কিছু একটা করে টাকা উপার্জন করা দরকার।
বি কম পরীক্ষা দেবার কিছু দিনের মধ্যেই পাড়ার এক দাদাকে ধরে একটি চার্টার্ড ফার্মে একাউন্ট আসিস্টেন্ট এর চাকরি পায়।কিন্তু মাস গেলে বুঝতে পারে যাতায়াত টিফিনের খরচা করার পরে হাতে যে টাকা পড়ে থাকে, তাই দিয়ে দুজনের সংসারে সাত দিনের বেশী বাজার করা যায় না। কাজ ছেড়ে দেয়।
বন্ধুরা পরামর্শ দেয় রোজগারের একমাত্র রাস্তা মার্কেটিং। সিম্পলি বেচুবাবু হয়ে যাও। ক্লিক করে গেলে উন্নতির শেষ নেই। সুযোগ পায় একটা ইংরেজি পাবলিশিং হাউসে। ডোর টু ডোর ঘুরে ডিকশনারি, বাচ্চাদের ছবি দেওয়া ইংরেজি বই বিক্রি। স্যালারি কিছু নেই, শুধু কমিশন আর ডেইলি কনভেন্স। প্রায় মাস দুয়েক চলল ভারী বইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দরজায় দরজায় ঘোরা। দেখা গেল মানুষ সবকিছুর মানে জেনে বসে আছেন, ডিকশনারির কোন প্রয়োজন নেই। জল ঝড় বৃষ্টিতে ঘোরাঘুরি পোষাল না।
প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মরত পাড়ার এক কাকু তাকে ব্যাংকে এক কাজ দিল। ক্রেডিট কার্ড বিক্রির বিনিময়ে কমিশন। সেটাও বেশিদিন টিকল না।ব্যাংক একদিন বলল, "এবার আসতে পারেন, অনেক এসির হাওয়া খেয়েছেন..."
প্রতীক বুঝতে পারল, মুখ দেখে কেউ টাকা দেয় না। এরপর পেপারের বিজ্ঞাপন দেখে চাকরি মিলল দেশের এক নামী ইলেক্ট্রনিক হোম অপালিয়ান্সের ডিলারের দোকানে সার্ভিস এক্সিকিউটিভ, ওয়াশিং মেশিন সার্ভিসিংয়ের কাজ। প্রথম সাত দিন ট্রেনিং তারপর কাস্টমার কমপ্লেন আর অন্যুয়াল মেন্টেনেন্স কন্ট্রাক্টের রুটিন সার্ভিসিং এর কাজ। কাজের কোন কমতি নেই। প্রায় রোজই দু তিনজন নতুন লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়। যেহেতু অধিকাংশ সময় দুপুরে গিয়ে কমপ্লেন এটেন্ড করতে হয়, তাই মহিলাদের সঙ্গেই পরিচয় বেশী হয়। সব কাজেই একটা ভাল দিক থাকে। সেরকম প্রতীকেরও বাড়তে থাকে পরিচিতি। সে লক্ষ করে মহিলাদের চরিত্র খুব চরম মানুষিকতার, হয় তারা ভীষণ স্নেহময়ী অথবা ভীষণ খিটখিটে ও সন্দেহপ্রবণ স্বভাবের। আরও লক্ষ করে সাধারণত যে সমস্ত মহিলাদের বয়েস ৩৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে তারাই বেশী খিটখিটে মেজাজের।
স্কুলে ও কলেজে পড়ার সময় প্রতীক ফুটবলটা ভালোই খেলতে পারত। এক্সারসাইজ করা পেটানো চেহারা তার। কলেজে পড়ার সময়ে প্যান্টের উপর ওর পছন্দের কোন টি শার্ট পরে টালির চালের কলঘরে ভাঙা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে এক এক সময়ে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যেত প্রতীক। পুরো ম্যাচো বলতে যা বোঝায় আর কি ? তখন নিজের রূপ নিয়েও যথেষ্ট সচেতন ছিল।
কিন্তু পরিস্থিতির চাপে আর সময়ের ব্যবধানে, রোজ এক্সারসাইজের সময় পায় না। চেহারা আগের মত না থাকলেও তাকে আলাদা করে দিত ওর সঙ্গে একই সাথে কাজ করা বাকি সাত আটজন সার্ভিস এক্সিকিউটিভদের থেকে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার সাফল্য লাভ করার অদম্য ইচ্ছাশক্তি। জান লড়িয়ে দিত সে। কাস্টমার একবার তাকে দিয়ে কাজ করালে, বারবার ডাকত।এ ছাড়াও তার ব্যবহার দিয়ে সে কাস্টমারের অর্ধেক মন জয় করে নিত। মা যার অক্ষর জ্ঞান হয়ত খুবই কম, তবুও মায়ের একটা কথা সে সবসময় মেনে চলত। মা বলতেন, মানুষের ব্যবহারটাই তার আসল গুন। অনেকেই তো পড়াশুনা করে খেটে ডাক্তারি পাস করে কিন্তু কোন ডাক্টর চেম্বারে বসে মাছি তারায়, আবার তার পাশেই একজন সমবয়সী ডাক্তারের চেম্বারে উপচে পড়া ভীড়। এটার কারণ তার ব্যবহার।
পরে ফিল্ডে কাজ করতে করতে সে বুঝেছে এটাই হচ্ছে আসল মার্কেটিং স্ট্রাটেজি। কাস্টমারের চরিত্র বুঝে, ভাল ব্যবহার দিয়ে, উপরি কিছু সুযোগ দিয়ে যাকে ইংরেজি ভাষায় বলে এড অন এডভান্টেজ দিয়ে কাছে টানতে হবে। যেমন ওয়াশিং মেশিনের কাজ করতে এসে খারাপ ইলেক্ট্রিক সুইচ ঠিক করে দেওয়া বা টিউব লাইট লাগিয়ে দেয়া বা কারও ওয়াশ বেসিনের কলের প্যাচ আলগা হয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে, সেটাকে স্লাইড রেঞ্জ দিয়ে টাইট করে জলের অপব্যবহার বন্ধ করা এইরকম সব কাজ সে হাসিমুখে করে দিত। প্রতীক তার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিল, এই এড অন সার্ভিসের জন্যেই লোকে কদর করে। মানুষের মধ্যে বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে এই উপরি পাওয়াটার প্রবণতা খুবই প্রবল। এছাড়া বয়েস অনুযায়ী দিদি, মাসিমা, কাকীমা, আন্টি, দিদা, ঠাকুমা এই সব তো আছেই।
এই ভাবেই একবার একটি আট কেজি ফ্রন্ট লোডিং (স্মার্ট টাচ এস এক্স) দামি ফুললি অটোমেটিক ওয়াশিং মেশিনের জটিল সমস্যা সমাধান করার জন্যে পরপর চার পাঁচ দিন আসতে হয় গার্গী পাকড়াশির বাড়ীতে। প্রতীক অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সারিয়ে দেয়। গার্গী লক্ষ করেন প্রতীকের ধৈর্য অধ্যবসায় ও হেরে না যাবার দৃঢ়তা, ঘন্টার পর ঘন্টা লেগে থেকে হাতের কাজ সফল্যতার সঙ্গে শেষ করার ইচ্ছাশক্তি। এই সূত্রেই প্রতীকের সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রবীনার সঙ্গে। গার্গী তার জহুরীর চোখ দিয়ে প্রতীকের মত হিরেকে চিনে নিতে দেরী করেননি। এরপর থেকে বাড়ীর ছোট বড় যে সমস্যা হলেই ডেকে পাঠাতে লাগলেন প্রতীককে। বিশ্বাস বাড়তে থাকে।
No comments:
Post a Comment